স্বর্ণ একটি মূল্যবান ধাতব পদার্থ আর কবিতা যথাক্রমে সাহিত্য ও ললিতকলার একটি অংগ। মাটির নীচের একটি খনি হতে উৎপত্তি, অপরটি কবির হৃদয়ের খনি হতে উৎপত্তি। স্বর্ণ জড় বস্তুু আর কবিতা কথা বলে – জীবন্ত। স্বর্ণের নিজস্ব কোন নড়ন-চড়ন নেই কিন্তু কবিতার উদ্ধৃতির চলা-ফেরা অনিবার্য সত্য। স্বর্ণ স্থির, শান্ত, নিরব ও নির্বাক, কবিতা অস্থির, অশান্ত, সবাক ও বাঙময়। এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও যুগ যুগ ধরে অনেক কবিরা এ দুটিকে এক করে দেখেছেন।
ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক যুগের অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি জন কিটস্ তার এক বিখ্যাত সনেট এ ভাবে শুরু করেছেন:
Much have I travelled in the realms of gold,
লাইনটির আক্ষরিক অনুবাদ ’আমি স্বর্ণরাজ্যসমূহ অধিক ভ্রমণ করেছি’। এখান ‘the realms of gold’ বলতে কবি ’কবিতার রাজ্য’ বুঝিয়েছেন অর্থাৎ তার বক্তব্য হলো যে তিনি অনেক দেশের বা অনেক অনেক কবিতা পাঠ করেছেন এখানে কবি কিটস স্বর্ণের সাথে কবিতাকে তুলনা করেছেন। যা পাঠকদের জন্য নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা সাহিত্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ’সোনার তরী’ একটি মহৎ কাব্যগ্রন্থ। এ বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থটি যথেষ্ট সুনামের অধিকারীও। ’সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটির নাম ’সোনার তরী’। কবি এক পর্যায়ে কবিতার মধ্যে এ ভাবে গেয়েছেন:
’ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী,
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।’
এখানে কবি ’সোনা’ (স্বর্ণ) কথাটি দুভাবে ব্যবহার করেছেন। একটি হলো ’সোনার তরী’ অপরটি হলো ’সোনার ধান’। কিটস্রে সোনা শব্দটি বিশেষ্য আর রবীন্দ্রনাথের ’সোনার’ শব্দটি বিশেষণ বা বিশেষ্য। কিটস্ ’কবিতা’-কে ’স্বর্ণরাজ্য’ বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ সেখানে কবিতাকে ’সোনার ধান’ বলেছেন। কিটস ’কবিতা পাঠক’ স্বর্ণভরা বা স্বর্ণময় রাজ্য ভ্রমণের সাথে তুলনা করেছেন। অপরদিকে রবীন্দ্রনাথ কবিতাকে সরাসরি উৎপাদিত ফসল ধান অর্থাৎ সোনার তৈরীতে রক্ষিত যে সোনা (ধান) তার সাথে তুলনা করেছেন। আর কবির সোনার ধানে যেহেতু তরী পরিপূর্ণ, সে কারণে কবিতার শিরোনাম ’সোনার তরী’ রেখেছেন। একজন ইংরেজ ও একজন বাঙালি এই দুই বড় কবির কবিতার মধ্যে যে ভাবেই হোক না কেন কবিতাকে স্বর্ণের সাথে তুলনা করা হয়েছে তাই কবিতাকে স্বর্ণের সাথে তুলনা করা বিষয়টি সাহিত্য-কাব্যে এই উৎপ্রেক্ষা Metaphor সৃষ্টি অত্যন্ত সুউচ্চ মেধার প্রতিফলন ও নান্দনিক চিন্তার স্ফুরণ।
এখন দেখা যাক কাব্যের সাথে কিভাবে স্বর্ণের তুলনা হতে পারে। এ ভাবে কবিরা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করে থাকেন। স্বর্ণ একটি মূল্যবান ধাতু, কবিতা জ্ঞানগর্ভ প্রজ্ঞাময় বচন, তাই কবিতাও জীবনের জন্য মূল্যবান। স্বর্ণের যেরূপ বাহ্যিক মূল্য আছে, কবিতাও তদরূপ বড় বড় পুরষ্কারও পেয়ে থাকে। পৃথিবীর প্রায় আদিকাল হতে স্বর্ণের অবদান পৃথিবীর মানবজাতির নিকট শাশ্বত। মানবজ্ঞানের আদিসৃষ্টি মহৎ কবিতার আবেদনও শাশ্বত। স্বর্ণের উজ্জ্বলতা রয়েছে, কবিতা শব্দের অনুসঙ্গ অনেক সময় এমন লালিত্য মধুর ঝংকারসহ রূপকল্পচিত্রে পরিপূর্ণ বঙময় হয়ে ওঠে যে কবিতারও উজ্জ্বলতা রয়েছে। স্বর্ণ সহজে ক্ষয় হয় না, মহৎ কবিতাও ক্ষয় হয় না, তার আবেদন কালোত্তীর্ণ। স্বর্ণের ব্যবহারে আকর্ষণ রয়েছে, কবিতা-পাঠের মধ্যে যথেষ্ট আকর্ষণ রয়েছে। স্বর্ণের রঙ দেখতে সুন্দর, কবিতার মধ্যে কবিরা ভাষার আড়ম্বর ও সুকোমল সৌন্দর্যে যে রঙ সৃষ্টি করেন তা সত্যিই অপূর্ব। স্বর্ণ দেশের অর্থের পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত হয়, কবিতা একটি দেশের উৎকৃষ্টমানের মহৎ কালজয়ী সাহিত্য সৃষ্টির পরিমাপ নির্ধারণ করে। তাই সোনা আন্তর্জাতিক মূল্যমান নিরুপণের মানদন্ড। কবিতাও তদরূপ আন্তর্জাতিক সম্মানে স্বর্ণের চেয়েও সম্মানীয় ও মূল্যবান। স্বর্ণের দ্বারা অলংকার তৈরী হয় এবং বিভিন্ন ধরনের কারুকার্যময় স্বর্ণের অলংকার মহিলাদেরকে সজ্জিত করার জন্য যুগ যুগ ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে। কবিতা দিয়েও কবিরা তাদের প্রিয়াকে মোহন সাজে সজ্জিত করে, সেখানে স্বর্ণের আদৌ প্রয়োজন হয় না। কবি নজরুলের ভাষায় কবিতার অলংকার:
’মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী
দেবো খোঁপায় তারার ফুল’
কর্ণে দোলাবো তৃতীয়া তিথীর
চৈতী চাঁদের দুল।
রবীন্দ্রনাথও প্রিয়ার প্রতি ভালোবাসা এ ভাবে প্রকাশ করেছেন:
’আমার মনের একটি মুকুর ভুলিয়া তুলিয়া রেখো তোমার কনক বন্ধনে’
কবি জীবনানন্দ দাশ তার ’শ্যামলী’ কবিতায় বলেছেন:
’সূদুর নতুন দেশে সোনা আছে বলে,
মহিলারি প্রতিভায় সে ধাতু উজ্জ্বল টের পেয়ে’-
সোনার উজ্জ্বলতা ও মূল্য তার শুধু নিজ গুণ নয়, মহিলাদের ’প্রতিভায়’ সোনা বরং উজ্জ্বলতা পেয়েছে এবং এ কথা কবি কবিতার ভাষা দিয়ে প্রমাণ করেছেন। সুতরাং স্বর্ণও যেমন কাব্যের বিষয়বস্তু, মহিলারাও তেমনি কাব্যের বিষয়বস্তু। স্বর্ণ ও এর তৈরী অলংকার দৈহিক সৌন্দর্যের আকর্ষণ বৃদ্ধি করে, তদরূপ কাব্যালংকার মানুষের হৃদয় মন ও জীবনের সৌন্দর্যের আকর্ষণ করে।
জীবনানন্দ দাশ তার বিভিন্ন কবিতায় ’সোনা’ ও ’সোনালী’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছেন। ’আমি যদি হতাম’ কবিতায় এক সুন্দর উপমা সৃষ্টি করে লিখেছেন:
সোনার ডিমের মতো
ফাল্গুনের চাঁদ।
’হায় চিল’ কবিতায় উল্লেখ করেন :
হায় চিল সোনালী ডানার চিল———
’গোধুলির সন্ধির নৃত্য’ কবিতায় সূর্য কখনো ’সোনার বলের’ মতো ইত্যাদি। সুতরাং জীবনানন্দের কবিতা রূপময়, রসময়, গন্ধময় ও বর্ণময় যা ইমপ্রেশনিজম ও ফবিজমের উদাহরণ হতে পারে। সোনার রঙ যেন জীবনানন্দের কাব্যিক কল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে (Poetic Vision) রঞ্জিত করেছে।
বর্তমান আধুনিক যুগের কবি আল মাহমুদ তার অমর সৃষ্টি সনেটগুচ্ছে স্বর্ণকে অবলীলাক্রমে ব্যবহার করে কবিতার উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করেছেন। তার ’সোনালী কাবিন’ সনেটগুচ্ছে কবি ’সোনালী’ শব্দটি এখানে কাবিনের বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সোনা যুগে যুগে নারীদেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধিকারী অলংকারের উপকরণ আর পুরুষের ঐশ্বর্যবৃদ্ধিকারী ধন সম্পদের আধার। ধাতু হিসেবে তাই স্বর্ণ চিরকাল আবেদনময়ী। তবে সাহিত্য জগতে সোনা প্রতীকী তাৎপর্য বহন করে। তাই কবি কিটস্ ও রবীন্দ্রনাথের পথ ধরে ভিন্ন ধারায় সোনালী কাবিনের কবি আল মাহমুদ নিজের কবিত্ব শক্তির ধারক একগুচ্ছ সোনার মতো মূল্যবান কবিতা তার প্রিয়তমাকে কাবিন হিসাবে উপহার দিতে চান:
সোনার দিনার নেই, দেন্মোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি,
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;
এখানে ’কাবিন’ কোন ভাবেই সাধারণ কাবিননামাকে মোহরানা বা বিবাহের চুক্তিপত্রকে বোঝায় না। অত্যন্ত আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কৃষক প্রতিনিধি স্বাধীনচেতা দেশ প্রেমিক, ধর্মভীরু কামকলায় পারদর্শী ভাটি অঞ্চলের সাম্যবাদী প্রেমিক তার প্রিয়াকে বিবাহের চুক্তি মোহরানাস্বরূপ একগুচ্ছ মহৎ সনেট প্রদান করেছেন, যার ছত্রে ছত্রে রয়েছে স্বর্ণের মতো উজ্জ্বল মূল্যবান বৈবাহিক জীবনের আত্মপ্রত্যয়, যা কবি কিটস্ ও রবীন্দ্রনাথের ভাবধারার সাথে সামঞ্জস্য। ৭নং সনেট কবি এ ভাবে শুরু করেন :
হারিয়ে কানের সোনা এ-বিপাকে কাঁদো কি কাতরা?
————————————————
সনেটটির কবি ইতি টানেন এ ভাবে :
তোমার দুধের বাটি খেয়ে যাবে সোনার মেকুর
না দেখার ভান করে কত কাল দেখবে চঞ্চলা?
সোনালী আঁশ যেমন শুধু পাটকেই বোঝায় না, বাংলাদেশীদের মনে তা এক ঐশ্বর্যময় ধারনার জন্ম দেয়, সোনালী কাবিনও ঐশ্বর্যময় কবিতার নিগুঢ় ধারণা দেয়। তবে একটি প্রশ্ন যে কবিরা যুগ যুগ ধরে কেন স্বর্ণকে কবিতার সাথে তুলনা করেছেন। স্বর্ণের চেয়ে আরো অনেক দামী ধাতব পদার্থ রয়েছে, আবার স্বর্ণের চেয়ে কম মূল্যবান ধাতুও রয়েছে। আমার মনে হয় মূল্যের দিক থেকে মাঝামাঝি একটি স্থানে স্বর্ণ বিরাজ করছে এবং ধাতব হিসেবে বিশেষ করে গুণ ও মানের তুলনায় জনপ্রিয়তায় ঔজ্জ্বল্য, মূল্য নিরুপণ ও প্রাপ্তিতে এক বিরল শাশ্বত পদার্থ। এ ছাড়া স্বর্ণের মূল্যায়নে এক সুদূর প্রসারী ইসলাম ধর্মে পুরুষের জন্য স্বর্ণ ব্যবহার করা নিষেধ আর হিন্দু ধর্মে বৈধব্যে সোনা পরিহারযোগ্য। ধর্মীয় দিক থেকে স্বর্ণকেও মূল্যায়ন করা হয়েছে। অপরদিকে সোনার সংসার সবার কাম্য, আবার ’তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই’ যদিও তা দুস্প্রাপ্য। সর্বোপরি সোনার অক্ষর অমরত্বের নিশ্চয়তা দান করে, যে অক্ষর দিয়ে কবিরা স্বর্ণের সাথে কবিতার তুলনা করেন।
(লেখক: কবি, গবেষক ও শিক্ষাবিদ)
খুলনা গেজেট/এমএম